রবিবার, ০৫ মে ২০২৪, ০৭:৩৩ অপরাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
ট্রাকের হেলপার থেকে মহাসড়কের স্বঘোষিত ‘সম্রাট’ মোহাম্মদ আলী

ট্রাকের হেলপার থেকে মহাসড়কের স্বঘোষিত ‘সম্রাট’ মোহাম্মদ আলী

স্বদেশ ডেস্ক:

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ও আন্তঃজেলা সড়ক এমনকি পাড়া-মহল্লায়ও ভূঞা ট্রান্সপোর্ট প্রাইভেট লিমিটেডের স্ট্রিকার সংযুক্ত ট্রাক, মিনিট্রাক, পিকআপ আর কাভার্ডভ্যান। প্রতিনিয়ত এসব দেখে প্রতিষ্ঠানটির গাড়ির পরিমাণ নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠছে। সম্প্রতি ক্যাসিনোকাণ্ড ও দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে রাঘববোয়ালরা গ্রেফতারের পর পরিবহন খাতে চাঁদাবাজিও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। সম্প্রতি জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় ফেনীর পরিবহন চাঁদাবাজি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন স্বয়ং জেলা প্রশাসক মো: ওয়াহিদুজ্জামান। ওই সভায় জেলা প্রশাসক বলেন, ‘পরিবহন খাতে ফেনীর মতো এমন প্রকাশ্য চাঁদাবাজি বিশ্বের কোথাও নেই।’ তার এ বক্তব্যে সবাই চমকে উঠলেও চাঁদাবাজি বন্ধে প্রশাসনের চোখে পড়ার মতো পদক্ষেপ দেখা যায়নি।

জানা গেছে, ২০১৪ সালে শহরের মহিপাল ফিলিং স্টেশনসংলগ্ন স্থানে তিনটি ট্রাক নিয়ে ট্রান্সপোর্ট ব্যবসায় শুরু করে ভূঞা ট্রান্সপোর্ট। এর মালিক মোহাম্মদ আলী। তিনি ২০১৬ সালে ফেনী জেলা ট্রাক, মিনিট্রাক, পিকআপ ও কাভার্ডভ্যান শ্রমিক (রেজি: নং- ৪৩৫) ইউনিয়নের নির্বাচনে সভাপতি হন। ইতোমধ্যে তার নিজের মালিকানাধীন গাড়ির সংখ্যা অর্ধডজন হলেও ফেনীর যত্রতত্রই দেখা যায় ভূঞা ট্রান্সপোর্টের লোগোসংবলিত গাড়ি। এর মধ্যে ট্রাক, পিকআপ, কাভার্ডভ্যান এমনকি ইমাও রয়েছে। শহরতলীর লালপোলে ইতোমধ্যে নিজস্ব টার্মিনালও গড়ে তোলেছেন তিনি। ফেনী শহরে অর্ধশত ট্রান্সপোর্ট প্রতিষ্ঠান থাকলেও সবাইকে ছাড়িয়েছে ভূঞা ট্রান্সপোর্ট।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সড়ক-মহাসড়কে আইনি ঝামেলা থেকে রেহাই পেতে প্রায় প্রতিটি ট্রাক, পিকআপ, কাভার্ডভ্যানে সাঁটানো হয় ভূঞা ট্রান্সপোর্টের নির্ধারিত স্ট্রিকার। প্রকারভেদে মাসিক হারে ১ থেকে ২ হাজার টাকা চুক্তিতে এসব স্ট্রিকার লাগানো হয়। আর ভর্তি হতে দিতে হয় ২ হাজার ৭ শ’ টাকা। ট্রান্সপোর্টটির নামে ‘টোকেন’ বাণিজ্য গোপন কিংবা নতুন কিছু নয়। বিষয়টি অনেকে স্বীকার করলেও নাম উদ্বৃত হয়ে কেউ এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

সম্প্রতি সদর উপজেলার কালিদহ ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামের এক ব্যক্তি নতুন ট্রাক (ঢাকা মেট্রো-গ-৩২-৪১৪৫) কিনেছেন। সব কাগজপত্র ঠিক থাকা সত্ত্বেও ‘সড়কে হয়রানি’ এড়াতে গত বৃহস্পতিবার তিনি ভূঞা ট্রান্সপোর্টে (ভর্তি) নাম লিখিয়েছেন।

দাগনভূঞার ট্রাক মালিক টিপু জানান, ভূঞা ট্রান্সপোর্টের স্ট্রিকার লাগানো হলে চট্টগ্রামের সিটি গেইট থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত নিরাপদে গাড়ি চালানো যায়। ট্রান্সপোর্টের মালিক মোহাম্মদ আলী প্রশাসনকে ম্যানেজ করায় কোনো ধরনের ঝামেলায় পড়তে হয় না। ফেনী শহরের জয়নাল আবদীন নামের আরেক মালিক জানান, তার দুটি ট্রাক রয়েছে। তিনিও একই পন্থা অবলম্বন করেছেন। ভূঞা ট্রান্সপোর্টের কত পরিমাণ গাড়ি চলে এর সঠিক তথ্য জানা যায়নি।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ফেনী জেলা ট্রাক, মিনিট্রাক ও কাভার্ডভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মোহাম্মদ আলীও গাড়ির পরিমাণ জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তবে সংশ্লিষ্ট অনেকে ধারণা করছেন, গাড়ি পরিমাণ ৪ হাজারের অধিক হবে। ইতোমধ্যে স্ট্রিকার বাণিজ্যের অভিযোগ এনে এর প্রতিকার চেয়ে ফেনী জেলা ট্রাক মালিক সমিতি ও ফেনী জেলা পিকআপ মালিক সমিতির পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দফতরে অভিযোগ করেন।

লিখিত অভিযোগে তারা, ঢাকা মেট্রো- নং- ৭৮০৬, ফেনী- ট- ০৫-০১৬৬, কুমিল্লা- ট- ১১-০০২৭, ফেনী- ট- ১১-০০২৩, ঢাকা মেট্রো- ট- ১৪-০৭৯৪, ফেনী- ট- ১১- ০২০৩, ঢাকা মেট্রো- ট- ১৮১৬৮২, যশোর- ট- ১১- ০০৩৭ গাড়ির নাম্বার উল্লেখ করেন। তাদের অভিযোগ, ‘ফেনী-চট্টগ্রাম হাইওয়ের মহিপালে প্রত্যেক ট্রাক ও পিকআপ হতে ভর্তি ফি তিন হাজার টাকা ও মাসিক ১ হাজার টাকা হারে চাঁদা আদায় করিতেছে। এই টোকেন গাড়ির সাথে লাগানো থাকিলে ট্রান্সপোর্টের নাম লিখা থাকিলে, ফেনীর ট্রাফিক বিভাগ কোনো গাড়ি আটক করিয়া গাড়ির কাগজপত্র দেখিবে না বা মামলা মোকদ্দমা করিবে না মর্মে প্রচার চালাইয়া ফেনীতে শত শত গাড়িকে টোকেনের আওতায় আনায় ফেনীতে সরকার ও বিআরটিএ রাজস্ব হারাচ্ছে। গাড়ির মালিক ও শ্রমিকরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধা হারাতে বসেছে। উল্লেখ্য, গাড়ির মালিকসহ আরো অন্যান্য মালিকরা এই বিষয়ে সাক্ষ্য প্রমাণ দিবে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নোয়াখালীর সেনবাগের এক ব্যক্তি জানান, তার অধীনে ৫০টি গাড়ি নোয়াখালী জেলায় চলাচল করে। ভূঞা ট্রান্সপোর্টের স্ট্রিকার লাগানো থাকায় কেউ এসব গাড়ি থামাতে সঙ্কেতও দেয় না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক চালক-মালিক জানান, বিভিন্ন নামে চাঁদা দিতে গিয়ে তারা সমস্যায় পড়ছেন। শুধু ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অঞ্চলের গাড়িই নয়, অন্য জেলার মালিকরাও ঝামেলায় না পড়তে ভূঞা ট্রান্সপোর্ট নামের এ প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করানো হয়। এ স্ট্রিকার থাকলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে কাউকে চাঁদা দিতে হয় না।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বলেন, ‘ট্রান্সপোর্ট এজেন্সির সাথে শ্রমিক ইউনিয়নের কোনো ব্যক্তি জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

জানতে চাইলে মহিপাল হাইওয়ে থানার ওসি মো: শাহজাহান খান বলেন, ‘আমি থানায় নতুন এসেছি। এ ধরনের কোনো বিষয় আমার জানা নেই। তবে গাড়ির ফিটনেস না থাকলেই মামলা দেয়া হয়।’

হাইওয়ে কুমিল্লা অঞ্চলের পুলিশ সুপার নজরুল ইসলাম বলেন, ‘হাইওয়ে পুলিশের নামে কোনো চাঁদা তোলা হয় না।’
বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি (বিআরটিএ) ফেনী অফিসের কর্মকর্তারা এ ব্যাপারে কথা বলতে চাননি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মালিকানা ছাড়া অন্যের গাড়িতে এ ধরনের স্ট্রিকার ব্যবহার বেআইনি। অভিযোগ প্রসঙ্গে মোহাম্মদ আলী মোবাইল ফোনে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করে তার সাথে অফিসে সাক্ষাৎ করতে বলেন।

কে এই মোহাম্মদ আলী

তিন দশক আগে ট্রাকের হেলপার দিয়ে শুরু হয় কর্মজীবন। এরপর চালক। সেই সুবাধে হয়ে যান শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতিও। সময়ের পরিক্রমায় ফেনীর পরিবহন সেক্টরে স্বঘোষিত ‘সম্রাট’ বনে যান নাঙ্গলকোট উপজেলার বাসিন্দা ‘মোহাম্মদ আলী’। এক শ্রেণীর রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনকে ম্যানেজ করায় তার চাঁদাবাজি ‘ওপেন সিক্রেট’।

১৯৯০ সালের দিকে ফেনী শহরে ট্রাক চালকের সহকারী হয়ে ফেনী আসেন মোহাম্মদ আলী। শ্বশুরবাড়ি হওয়ার সুবাধে সপরিবারে শহরের বারাহীপুর এলাকায় বসবাস তার। কিছু দিন পর চালক হয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। এরপর স্থানীয় লতিফ ভূঞা নামের এক ট্রান্সপোর্ট ব্যবসায়ীর প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। লতিফ ভূঞা বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়লে ২০১৪ সালে ওই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নেন মোহাম্মদ আলী। ক্রমেই ওই প্রতিষ্ঠানের পুর্ণ নিয়ন্ত্রন চলে আসে তার হাতে। নাগাল পেয়ে যান আলাদীনের চেরাগ। ফেনী ছাড়াও ঢাকা-চট্টগ্রামেও হয়ে যায় ভূঞা ট্রান্সপোর্টের দুটি শাখা। গুটি কতেক রাজনৈতিক নেতার প্রশ্রয়ে ২০১৬ সালে ফেনী জেলা ট্রাক, মিনি ট্রাক, পিকআপ ও কাভার্ডভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হন। এরপর তাকে পেছনে তাকাতে হয়নি। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ও আঞ্চলিক মহাসড়কে চলাচলকারী ট্রাক, মিনি ট্রাক, পিকআপ, ইমা ও কাভার্ডভ্যানে ‘ভূঞা ট্রান্সপোর্টের’ স্ট্রিকার লাগিয়ে দেন। এসব স্ট্রিকার বাবত মাসে চাঁদা ওঠে লাখ লাখ টাকা।

শহরের মহিপাল ফিলিং স্টেশনসংলগ্ন ভূঞা ট্রান্সপোর্টের কার্যালয় থাকলেও লালপোলে নিজস্ব টার্মিনালে রয়েছে আরেকটি কার্যালয়। শ্রমিক ইউনিয়নের কয়েকজনকে নিয়ে একটি সিন্ডিকেটও গড়ে তোলেন।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877